ডায়না পামারের সাথে প্রায় রাতে ছুটে বেড়ানো গাঢ় অন্ধকারে, জ্যোৎস্নায়, বনে-জঙ্গলে, সোনালি সৈকতে, পিরন্ হা মাছেদের শরীর ঘেঁষে। আমি আর ডায়না। পিগমীদের সাথে, বুড়ো মজ, রেক্স, তুফান আর অন্যান্য সকলের সাথে কেটেছে কিছু মুহূর্ত। কখনো-সখনো পূর্বজদের-ঘষা মুখ চেনার কৌতূহলে, বেতাল-গুহায় অফুরন্ত মোমবাতিটির সামনে। মোমবাতিটি, কতযুগ ধরে জ্বলতে জ্বলতে অর্ধেক হয়েছে বা প্রথম থেকেই অর্ধেক ছিলো কিনা– জানা নেই। শুধু জানি, আমি আর ডায়না যখন থেকে তাকে দেখছি – সে অইরকমই। আদিম আলো।
সেই থেকে অফুরন্ত, সাই-সাই বাতাসের ভেতর,জলে-স্থলে ওড়াউড়ি; ঘোরা আর ঘোরা আর ফ্ল্যাশ গর্ডন, টিনটিন, লোথার, ম্যানড্র্যাকের যাদুছড়ি ঢের ছিল জীবন্ত। স্বপন কুমারের কালনাগিনীকে ফাইভ স্টার ছুঁড়ে দিয়ে তৎপরতাহীন ডায়নাকে নিয়ে ওঠে যেতাম গাছবাড়িতে। সেখানে, এক দারুণ মুহূর্তে, শরীরে লেগে থাকা- বেলাভূমির সোনালি বালি, আমাকে চিহ্নিত করেছিল – ভূমিপুত্র। এরপর, আমি আর কোথাও যেতে পারি না। থাকতে পারি না। যতদূরে যাই- যেখানেই যাই- এক অবোধ ধ্বনি আমায় টেনে আনে – ভূমিতে। অথচ, এখানে দাঁড়াতে পারি না। অই থেকে প্রচণ্ড এক জ্বরে আক্রান্ত, বুঝতে পারিনি লোথার কখন আমার শুক্রপতিতে স্থান নিয়েছে।
একটা সময় গাছবাড়ি থেকে আমার বিভৎস সুন্দর অবতরণ। কাঁটাঝোপ আর ঘাস আর কীট-ফড়িঙের মাঝে। তারপর সুতো আর সেতু, সেতু আর সুতোতে জড়িয়ে পরা। ততক্ষণে, চুলের ভেতর আটকে থাকা বেলাভূমির সোনালি বালি ঝরে গেছে। উৎপাটিত হয়েছে – গাছবাড়ি। যেখানে,ডায়না ছিল। আমি এগলি-ওগলি এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ঘুরে একদিন রাজপথে এসেও তাকে পাই নি।
শুধু বাতাসের ভেতর তার ডাক শুনতে পাই। অবিরাম। আর ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে তড়িৎ কণাবাহীর মতো কোথা থেকে কোথায় ঢুকে পড়ছি- বেড়িয়ে যাচ্ছি। ছুটে বেড়াচ্ছি। বাতাসে তার কণ্ঠস্বর। মাথা চুইয়ে পরা ঘামে নোনাগন্ধ, - নাকে লাগতেই প্রবল এক চঞ্চলতা আমাকে আরো বেশি করে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেদিকে তাকাই তার কুয়াশা মাখানো মুখ, মাঠের ওপাশের ভোরের লাল বলটির মতো কখনো স্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়, মুহূর্তে। আর প্রচণ্ড আক্রোশে খালি করি, কপালের উপর থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল। এবং এভাবে নিজেকে পান করতে করতে নি:শেষ করা হলো না আমার। লোথার, একমাত্র লোথার আমার শীর্ণ হাতের তালুতে ভয়ানক উঁচু হয়ে আছে – এখনও।
ক্রমশ: কি অদ্ভুত মাটিতে আটকে যাচ্ছে পা ! এতো তাপ, এতো উষ্ণতা বাতাসের ভেতর ! শিবিরে শিবিরে এতো মানুষ ! কোথা যায় এরা ! কোথা থেকে ফেরে ! কে গেল সকালে আর কে ফিরে এলো সন্ধ্যেতে এবং বেড়িয়ে গেল পুনরায় ! ইত্যাদি সব আরো বেশি সুতো আর সেতুতে জড়িয়ে ফেলে। আর হ্যাঙারে ঝোলানো আমার ধুলোমাখা-শরীরের জলে চোবানো জামাখানি- বহন করে, আমার সারা সপ্তাহ-মাস-প্রতিদিনের মত্ততা, শ্রম।
শহুরেপনার নাটুকে সসঁকিতির সাথে যার বিনিময় করা সম্ভব নয়- আর। অথচ, ডায়না, এক ত্রিসন্ধ্যায় কাউকে আমি আঙুল থেকে খুলে দিয়েছিলাম, খুলি আংটি। আর অই নারী তাতে চুমু খেয়ে ছুঁড়ে দিলো এক কূয়োতে- সাকুল্যে যার আয়তন ১০, ৪৯৯ বর্গ কি.মি.।
সেই থেকে বেতাল চূড়ায় বাজছে – নাবাল ড্রাম। দ্রিম্ দ্রিম্ দ্রিম.......। ডায়না কি সেখানে ? ডায়না !
কে চলে গেল বুকের মাঝ দিয়ে ?
গুলি ? শ্রম ? না স্বাধীনতা?